বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
বর্তমানে শবে বরাত অর্থাৎ
লাইলাতুন নিসফি মিনশাবান এর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন হাদীস পেশ করা হচ্ছে।
এবং এটি নিয়ে তর্কও হচ্ছেবিশাল, তাই আমার এই আর্টিকেলটি লেখা হল।১. সর্বপ্রথম লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ শবে বরাত এর ফজিলত আছে-কিনা তা নিয়ে আলোচনা করা যাক,
এই রাতের ফযিলতের পক্ষের হাদীসগুল নিম্নরুপঃ
১. আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: এক রাতে আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুঁজে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম, আমি তাকে বাকী গোরস্তানেপেলাম।
তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন: ‘তুমি কি মনে কর,আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন?’ আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণাকরেছিলাম যে আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর নিকট চলে গিয়েছেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বললেন: ‘মহান আল্লাহ তা’লা শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণহন এবং কালব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে বেশী লোকদের ক্ষমা করেন।
হাদীসটিইমাম আহমাদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন (৬/২৩৮), তিরমিযি তার সুনানে (২/১২১,১২২) বর্ণনাকরে বলেন, এ হাদীসটিকে ইমাম বুখারী দুর্বল বলতে শুনেছি। অনুরূপভাবে হাদীসটি ইমাম ইবনেমাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৯) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির সনদ দুর্বল বলে সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত।
২. আবু মূসা আল আশ’আরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানেরমধ্যরাত্রিতে আগমণ করে, মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্তব্যক্তিদের ব্যতীত, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমাকরে দেন।
হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০),এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থেবর্ণনা করেছেন।
আল্লামা বূছীরি বলেন: ইবনেমাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী(রাহমাতুল্লাহিআলাইহি)
মাজমা‘ আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির
সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী। হাদীসটি ইবনেহিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা
করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম‘আন, হাদীস নং (১৯৮০), পৃঃ
(৪৮৬)।
৩. আলী ইবনে আবী তালিব (রাদিয়াল্লাহুআ
তিনি বলেনঃরাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহুআলাইহি
ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যখন শা‘বানের মধ্যরাত্রি আসবে তখন তোমরা সে রাতের
কিয়াম তথা রাতভর নামায পড়বে, আর সে দিনের রোযা রাখবে; কেননা সে দিন
সুর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন:
ক্ষমাচাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি ক্ষমা করব। রিযিক চাওয়ার কেউ কি আছে
যাকে আমি রিযিকদেব। সমস্যাগ্রস্ত কেউ কি আছে যে আমার কাছে পরিত্রাণ কামনা
করবে আর আমি তাকেউদ্ধার করব। এমন এমন কেউ কি আছে? এমন এমন কেউ কিআছে?ফজর
পর্যন্ত তিনি এভাবে বলতে থাকেন”।
হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮) বর্ণনা করেছেন। আল্লামা বূছীরি (রাহমাতুল্লাহিআলাইহি) তার যাওয়ায়েদেইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইবনে আবিসুবরাহ রয়েছেন যিনি হাদীস বানাতেন। তাই হাদীসটি বানোয়াট।
৪.মুয়া'জ বিন জাবাল (রা)থেকে বর্ণিত :
তিনি বলেন, আল্লাহ ১৫ই শা'বানের রাতে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করে দেন।
ইমামইবনে হাব্বান তার ছহিহ, ইমাম বায়হাক্বী তার শুয়াবুল ইমান, ইমামতাবরানী আল মু'জামুল কাবীর এবং আবু নায়ী'ম আল হুলয়ার মধ্যে এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাইসামী এই হাদিসটি বর্ণনা করারপর বলেন, এই হাদিসটির সকলবর্ণনাকারী বিশ্বস্ত এবং হাদিসটি ছহিহ।
এছাড়াইমাম মুনজারী আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে, ইমাম সুয়ুতী দুররুল মান্সুরে ও শেখ আলবানী তারসিল্সিলাতুছ ছাহীহাহও এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।৫.আবি সা'লাবাহ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
যখন ১৫ই শা'বানের রাত আসে তখন, আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফকরে দেন। এবং তিনি তাদেরকে তাদের শত্রুতার মধ্যে রেখে দেন।
ইমামবায়হাক্বী তার শুয়া'বুল ইমান, ইমাম সুয়ুতী দুররুল মান্সুরে ও শেখআলবানী তার সিল্সিলাতুছ ছাহীহাহ হাদিসটি বর্ননা করেছেন. হাফিজ বিন আ'ছিম কিতাবুস সুন্নাহতেও উল্লেখ করেছেন।৬.অব্দুল্লাহ বিন আ'মর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
আল্লাহ ১৫ই শা'বানের রাতে তাঁর সমস্তসৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। দু'ব্যক্তি; খুনি ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করেদেন।
এইহাদিসটি ইমাম আহমদ তার মুসনাদে ও ইমাম হাইসামী মাজমাউজ জাওয়াইদে, ইমাম মুনজারী আত- তারগীব ওয়াত-তারহীবগ্রন্থে ও শেখ আলবানী তার সিল্সিলাতুছ ছাহীহাহও বর্ননা করেছেন।
উপরক্ত ১ ও ৩ নং হাদীসটি একেবারেই দুর্বল।বাকীগুলো
“আল্লাহ১৫ই শা'বানের রাতে তাঁরসমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করে দেন।” এই শব্দতেই৪টি হাদীস বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং প্রকৃত পক্ষেই ১৫ই শাবানের রাতে আল্লাহ পাক মুশরিক ও সুন্নত বিরোধীঅথবা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যাক্তি ব্যাতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
এইরাতের ফযিলত স্বীকার করেছেনঃ
১. ইমামশাফেঈ (রাহমাতুল্লাহিআ
২. ইমাম আহমাদ (রাহমাতুল্লাহিআ
৩. ইমাম আওযায়ী (রাহমাতুল্লাহিআ
৪. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহমাতুল্লাহিআ
৫. ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী (রাহমাতুল্লাহিআ
৬. প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) [ছিলছিলাতুল আহাদীসআস্সাহীহ
৭. বাংলাদেশের প্রখ্যাতআলেম মুফতি কাজী ইবরাহিম
সুতরাংলাইলাতুন নিসফি মিন শাবান অথবা শবে বরাতের ফযিলত প্রমানিত।
২.এই রাতে ইবাদাত করা যাবে-কি-যাবে না সেই বিষয়ে আলোচনা করা হলঃ
লাইলাতুননিসফি মিন শাবান অর্থাৎ শবে বরাত এর রাতে ইবাদাত করার পক্ষে একটিও সহীহ হাদীস নেই।
যারাএই রাতে ইবাদাতের পক্ষে কথা বলেন তারা এই বলে যুক্তি দেন যে, ফযিলতপূর্ণ রাতকিঘুমিয়ে কাটিয়ে দিব? এটা তো ওযৌক্তিক। এছাড়া তাদের আর কোন দলীল ও যুক্তি নেই।
এইরাতে ব্যাক্তিগত ইবাদাত করার পক্ষে মত দিয়েছেনঃ
১. ইমাম আওযা‘য়ী
২. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া
৩. আল্লামা ইবনে রজব
এইরাত উপলক্ষে যে কোন ইবাদাত করা কে বিদ’আত বলেছেনঃ
১.প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ
২. ইবনে আবি মুলাইকা
৩. মদীনার ফুকাহাগণ
৪. প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ীআব্দ
৫. ইমাম মালেকের ছাত্রগণ
৬.শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায
ইমামআহমাদ ইবন হাম্বল(রাহিমাহু
কোন ইবাদাতের ক্ষেত্রে কোন আলেমের মন্তব্যদলীল নয়, বরং দলীল হল আল্লাহর কিতাব(কোরআন) ও রাসুলুল্লাহ(সাল
কোন দিন অথবা রাতের ফযিলত থাকলেই তাতে ইবাদাতকরা যাবে বা করতে হবে এরুপ কোন বিধান ইসলামে নেই। বরং সহীহ হাদীসে আমরা তারউল্টোটা দেখতে পাই, যেমনঃ
রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“সুর্য যে দিনগুলোতে উদিত হয় তম্মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ট দিন, জুম‘আর দিন”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৮৪)
এ থেকে প্রমানিত হয় যে জুম’আর দিনের ফযিলতরয়েছে,
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তোমরা জুম‘আর রাত্রিকে অন্যান্য রাত থেকে ক্বিয়াম/ নামাযের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, আর জুম‘আর দিনকেও অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা করে রোযার জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, তবে যদি কারো রোযার দিনে সে দিন ঘটনাচক্রে এসে যায় সেটা ভিন্ন কথা”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৪৪, ১৪৮)
উপরের হাদীস থেকে প্রমানিতহয় যে জুম’আর দিন ও রাত উপলক্ষে কোন ইবাদাত করা যাবে না, কিন্তু জুম’আর দিনেরফযিলত তো রয়েছে, তার পরও জুম’আর দিন উপলক্ষে ইবাদাত করা যাবে না, এটিই প্রমান করেযে ফযিলত থাকলেই যে ইবাদাত করতে হবে এমন কোন কথা নেই।
এছাড়াও ফযিলতের সাথেইবাদাতের কোন সম্পর্ক নেই, এর আরেকটা উদাহরন হল লাইলাতুল ক্বাদর।
আমরা জানি যেরাসুলুল্লাহ(স
এই নীতি(ফযিলত থাকলেইবাদাত করা) আমরা বানিয়ে নিয়েছি, এছাড়াও আমরা জানি যে আযান ও ইকামাত এর মধ্যে দোয়ারদ হয় না, অর্থাৎ আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়টি ফযিলতপূর্ণ, তাই বলে কি এখনথেকে আযান ও ইকামাতের মধ্যেও একে কেন্দ্র করে সালাত আদায় করবো? ফজিলততো রয়েছে,ইবাদাত করতে দোষ কোথায়, তাই না!!!
জুম’আর দিনের তো ফযিলতরয়েছে তার পরও রাসুলুল্লাহ(সাল
সুতরাং ফযিলত থাকলেইইবাদাত করা যাবে না, বরং ইবাদাত করার জন্য কোরআন ও সহীহ হাদীস থেকে দলীল প্রয়োজন।
কেননারাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে যা এর মধ্যে
নেই, তা তার উপর নিক্ষিপ্ত হবে”
[সহীহ বোখারী, হাদীস নং ২৬৯৭]
এবং,রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করবে যার উপর আমাদের দ্বীনের মধ্যে কোন নির্দেশ নেই তা অগ্রহণযোগ্য”
[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮]
যেহেতু লাইলাতুন নিসফি মিনশাবান অর্থাৎ শবে বরাতের রাতে কোন ইবাদাত করার পক্ষে কোন সহীহ হাদীস নেই, এটাইপ্রমান করে যে এই রাতে ইবাদাত করা যাবে না, যদি আসলেই এই রাত ইবাদাতের রাত হত তাহলেএর পক্ষে অবশ্যই সহীহ হাদীস থাকতো। কিন্তু কোন সহীহ হাদীস নেই এই রাতে ইবাদাত করারপক্ষে সুতরাং এই রাত উপলক্ষে ইবাদাত করা অগ্রহণযোগ্য ও বিদ’আত।
এখন কেউ বলতে পারেন যে,ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ(রাহি
তার উত্তরে আমি বলব যে,ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ(রাহি
এছাড়াও কিছু তাবেয়ী এইরাতে ইবাদাত করার পক্ষে মত দিয়েছেন, যে সমস্ত তাবেয়ীনগণ থেকে এ রাত উদযাপনের সংবাদ এসেছে তাদের সমসাময়িক প্রখ্যাত ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনগণ তাদের এ সব কর্মকান্ডের নিন্দা করেছেন। যারা তাদের নিন্দা করেছেন তাদের মধ্যে প্রখ্যাত হলেনঃ তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে আবি রাবাহ(রাহিমাহুল
এছাড়াও এই রাত পালনেরপ্রতিবাদে
মদীনার প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম
বলেছেনঃ“আমাদের কোন উস্তাদ, আমাদের মদিনার কোনো ফকিহ, কোন আলেমকে দেখিনি
যে, শাবান মাসেরমাঝের রাতের(শবে বরাতের) দিকে কোন রকম মনোযোগ দিয়েছেন বা
ভ্রুক্ষেপ করেছেন। এবিষয়ে সিরিয়ার তাবেয়ী মুহাদ্দিস মাকহুল যে হাদীস বর্ণনা
করেন সে হাদীস তাদের(মদীনারফুকাহা) কারো মুখে কখনো শুনিনি”
[ইবনু ওয়াদ্দাদ, আল-বিদাউ পৃঃ ৪৬]
[ইবনু ওয়াদ্দাদ, আল-বিদাউ পৃঃ ৪৬]
সুতরাং কোন আলেমের কথার উপর ভিত্তি করে আমল/ইবাদাত করা যাবে না, বরং ইবাদাত করার জন্য কোরআন ও সহীহ হাদীসের দলীল প্রয়োজন।