Saturday, May 31, 2014

ত্বাওয়াগীত তথা ত্বাগূত হলো, আল্লাহ তায়ালার পরিবর্তে যার ইবাদত করা হয় (১)

ত্বাওয়াগীত তথা ত্বাগূত হলো, আল্লাহ তায়ালার পরিবর্তে যার ইবাদত করা হয় (১ম পর্ব)। শাইখ আব্দুল মুনয়িম মুছত্বফা হালীমাহ

বিসমিল্লাহির  রাহমানির রাহীম ।

ত্বাগূত–যাদেরকে বর্তমানে আল্লাহর পরিবর্তে ইবাদত করা হচ্ছে,তাদের পরিচয় লাভ করা শ্রেয় হবে- যেন আমরা তাদের পরিহার করতে পারি এবং এদের উপর শারীয়াতের ওয়াজিব বিধান প্রয়োগ করতে পারি। আমরা সর্ব প্রথম ত্বাগূতদের মূল ও প্রধান নেতা দ্বারা আলোচনা শুরু করছি।



  • ১ – اَلشَّيْطَانُ – শয়তানঃ


সে হলো অভিশপ্ত। যে নিজের উপর প্রতিজ্ঞা করেছিল- বান্দাদেরকে আল্লাহর তায়ালার ইবাদত হতে দূরে রেখে অন্যের ইবাদতের দিকে আকৃষ্ট করবে।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ﴿١٦﴾ ثُمَّ لآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَآئِلِهِمْ وَلاَ تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ ﴿١٧
(ইবলীস) বলল- আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন এ কারণে আমিও শপথ করে বলছি- আমি তাদের জন্যে সরল পথে অবশ্যই ওঁৎ পেতে বসে থাকব।  * অতঃপর আমি (পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে) তাদের সম্মুখ দিয়ে, পিছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে তাদের কাছে আসব, আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞরূপে পাবেন না।
(সূরা আ’রাফ, ১৬-১৭ নং আয়াত)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেনঃ
رَبِّ بِمَآ أَغْوَيْتَنِي لأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الأَرْضِ وَلأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ﴿٣٩﴾ إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ﴿٤٠
সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেব। আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত।      (সূরা হিজর, ৩৯-৪০ নং আয়াত)
অতএব, ঐ লোকদের উপর তার কোন ক্ষমতা নেই।
আর উক্ত গুণ দ্বারা অনেক মানব শয়তান গুণান্বিত হয়েছে, যারা নিজেদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে এবং শিরক, কুফরও বিভ্রান্তিকে সাহায্য করার দায়ভার বহন করার জন্য সুদৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّىَ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُواْ
বস্ততঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষর্ণ পর্যন্ত তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন হতে ফিরাতে না পারে যদি তা সম্ভব হয়।
(সূরা বাকারহ, ২১৭ নং আয়াত)

যদি প্রশ্ন করা হয়,  নিশ্চয় ত্বাগূত হলো আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত করা হয়; অতএব, শয়তানের  উদ্দেশ্যে মানুষের ইবাদত কিরূপে হতে পারে?
এর উত্তরে আমরা বলবঃ কুফরী ও শিরক করার ক্ষেত্রে তার আনুগত্য ও অনুসরণ করার দিক দিয়ে ইবাদত বা দাসত্ব করা হয়।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
হে বানী আদম, আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়নি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।    
(সূরা ইয়াসীন, ৬০ নং আয়াত)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেনঃ
إِن يَدْعُونَ مِن دُونِهِ إِلاَّ إِنَاثًا وَإِن يَدْعُونَ إِلاَّ شَيْطَانًا مَّرِيدًا
তারা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে শুধু নারীর আরাধনা করে এবং শুধু অবাধ্য শয়তানের পূজা করে। (সূরা নিসা, ১১৭ নং আয়াত)
এবং ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলঃ  يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا
হে আমার পিতা, শয়তানের ইবাদত করো না। নিশ্চয় শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য।
(সূরা মারইয়াম, ৪৪ নং আয়াত)


  • ২ – أَلْهَوٰى – প্রবৃত্তিঃ


أَلْهَوٰى– ‘প্রবৃত্তি’ কখনো اَلْمَيْلُ ‘ঝোঁক’ اَلْحُبَّ ‘ভালবাসা’ اَلْعِشْقُ ‘অনুরাগ’ বা ‘প্রেম’ -এর অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং ‘কল্যাণ ও অকল্যাণ’ -এর প্রবেশদ্বারেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং কোন জিনিসের ইচ্ছা করা ও কামনা করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। এবং هَوَى النَّفْسِ অর্থাৎ اِرَادَتُهَا এর ‘ইচ্ছা করা’।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ       وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى
এবং যে ব্যক্তি খেয়াল-খুশী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে।
(সূরা নাযিআত, ৪০ নং আয়াত)

এর অর্থ হলোঃ সে নিজেকে স্বীয় প্রবৃত্তি থেকে বিরত রেখেছে এবং এটা আল্লাহর অবাধ্যতায় যে সকল কাজের দিকে তাকে তা হতে নিবৃত্ত রেখেছে।
আর যখন সাধারণভাবে أَلْهَوٰى ‘প্রবৃত্তি’ শব্দ উচ্চারণ করা হবে, তখন গুণবাচক কোন শব্দ উল্লেখ না করা পর্যন্ত -এর দ্বারা নিন্দনীয় বিষয়ই উদ্দেশ্য হবে। যেমন তাদের কথাঃ هَوَى حَسَنٌ – ‘উত্তম প্রবৃত্তি; এবং هَوىً مُوَافِقٌ للِّصَّوَابِ (উক্ত) প্রবৃত্তি সত্যের অনুকুলে। (লিসানুল আরব। আমি (লেখক) বলছি কুরআনে কারীমে নিন্দনীয় শব্দের দ্বারাই শুধুমাত্র أَلْهَوٰى ‘হাওয়া’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে)
‘প্রবৃত্তি’ কোন কোন অবস্থায় ‘ত্বাগূত’ ও ‘মা‘বূদে’ পরিণত হয়ে যায়। তা হলো যদি আল্লাহর অবাধ্যতায় এর অনুসরণ ও আনুগত্য করা হয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে এটাকে বিধান দানের মূল নির্ধারণ করা হয়Ñ এ ভাবে যে তার প্রবৃত্তি যে টাকে সত্য বলে মনে করবে প্রকৃত পক্ষে ওটাই সত্য। আর প্রবৃত্তি যেটাকে বাতিল বা মিথ্যা মনে করবে তবে ওটা বাতিল বা মিথ্যা, যদিও ওটা আল্লাহ তায়ালার শারীয়াতের পরিপন্থী হয়।
তদ্রুপভাবে ‘প্রবৃত্তি’ কে কেন্দ্র করেই বন্ধুত্ব স্থাপন করা এবং শত্রুতা করা। এভাবে যে স্বীয় প্রবৃত্তি যেটা কামনা করে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে যেটাকে কেন্দ্র করে বন্ধুত্ব স্থাপন করা ওয়াজিব তার ভিত্তিতে নয়। স্বীয় প্রবৃত্তি যার সঙ্গে দুশমনী রাখে তার সাথে শত্রুতা করে; যদিও তার সাথে শরীয়াতের দিক দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপন করা ওয়াজিব।
সুতরাং এমতাবস্থায় ‘প্রবৃত্তি’ আল্লাহর পরিবর্তে ভিন্ন মা’বূদ। সে প্রকৃত পক্ষে স্বীয় খেয়াল-খুশীকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করল এবং এটাকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ নির্ধারণ করে নিল।

যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَن ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।
(সূরা কাহ্ফ, ২৮ নং আয়াত)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেনঃ    أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا
আপনি তাকে কি দেখেন না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন?
(সূরা ফুরকান, ৪৩ নং আয়াত)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেনঃ    أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ
আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন।
(সূরা জাসিয়া, ২৩ নং আয়াত)

ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির পূজা করে, তবে সে তো খেয়াল-খুশীকে ইলাহ (উপাস্য) হিসাবে গ্রহণ করল। তার প্রবৃত্তিই তার ইলাহ। যিনি ইলাহ হওয়ার উপযুক্ত তাকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে না; বরং স্বীয় প্রবৃত্তিকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করে। আর উক্ত প্রবৃত্তিকে উলাহরূপে গ্রহণকারী ব্যক্তির-এর প্রতি মুহাব্বাত রয়েছে; যেমন মুশরিকদের স্বীয় উপাস্যদের প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে এবং গোবৎস পূজারীদের গোবৎসের প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। আর এটা আল্লাহর সঙ্গে ভালবাসা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে মুহাব্বাত করা নয়। এটা মুশরিকদের অনুরূপ ভালবাসা।
আর অন্তর কখনো কখনো আল্লাহকে ভালবাসার দাবী করে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এটা শিরকী মুহাব্বাত হয়ে থাকে। তার প্রবৃত্তি যা কামনা করে সে তাকে ভালবাসে এবং কখনো কখনো অন্তর আল্লাহর ভালবাসার সঙ্গে প্রবৃত্তিকে শরীক করে থাকে।
(আল-ফাতাওয়া, ৮/৩৫৯)


  • ৩ – اَلسَّاحِرُ যাদুগরঃ


সে হচ্ছে ত্বাগূত। কেননা সে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা আছে বলে দাবী করে। অতএব, সে যার প্রতি ইচ্ছা অকল্যাণ পৌঁছায় এবং যাকে ইচ্ছা তার থেকে বিপদ দূর করতে পারে। আর এটা হল আল্লাহ তায়ালার বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে হতে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেমন ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
তবুও অনেক লোক তাওহীদ এবং তাদের উপর আল্লাহর হক বিষয়ে অজ্ঞ থাকার দরূণ বিভিন্ন বিষয়ে উপকার ও ক্ষতি করার দিক দিয়ে প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা আছে বলে তাদের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের দিক দিয়ে তারা যাদুকরদের ইবাদত বা পূজা করে থাকে। এবং ভীতি, আশঙ্কা ও আশা করার দিক দিয়ে এভাবে যে, তারা তাদের কাছে আশা করে যে, তারা তাদের উমুক উমুক উপকার করতে পারবে কিংবা কোন রোগ-শোক এবং অন্যান্য বিপদ দূর করতে পারবে।
এ জন্য নিশ্চয় যাদুকর হচ্ছে ত্বাগূত, কাফির। ইসলামে তার শাস্তি হচ্ছে তরবারির আঘাতে তার মস্তককে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে।
তার কাফির হওয়ার দলীল হচ্ছেঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ

وَاتَّبَعُواْ مَا تَتْلُواْ الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَـكِنَّ الشَّيْاطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولاَ إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ
অর্থঃ এবং সুলাইমানের রাজত্বকালে শয়তানরা যা আবৃত্তি করতো, তারা ওরই অনুসরণ করছে এবং সুলাইমান কুফরী করেনি, কিন্তু শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা লোকদেরকে যাদুবিদ্যা এবং যা বাবেলে হারুত-মারুত ফেরেশেতাদ্বয়ের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল তা শিক্ষা দিতো, এবং তারা উভয়ে কাউকেও এটা শিক্ষা দিতো না- এমনকি তারা বলতো যে, আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছুই নই, কাজেই তুমি কাফির হয়ো না।
(সূরা বাক্বারাহ, ১০২ নং আয়াত)

কুরতুবী (রঃ) তাফসীরে বলেছেনঃ তাঁর বানীঃ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ ‘সুলাইমান কুফরী করেনি’-এর দ্বারা আল্লাহর পক্ষ হতে সুলাইমান (আঃ)-এ জন্য নির্দোষ প্রমাণ করা হচ্ছে; আর আয়াতে এমন কিছু উল্লেখ নেই যে, কেউ তাঁকে সুলাইমান (আঃ) কুফরীর দিকে সম্পৃক্ত করেছে।
কিন্তু ইয়াহুদীগণ তাকে যাদুর দিকে সম্পৃক্ত করেছে। আর যেহেতু যাদু করা কুফরী সুতরাং এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, কেউ তাকে কুফরীর দিকে সম্পৃক্ত করেছে।
অতঃপর তিনি বলেছেনঃ  وَلَـكِنَّ الشَّيْاطِينَ كَفَرُواْ  “কিন্তু শয়তানেরা কুফরী করেছে”।
অতএব, তিনি যাদু শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের কুফরী প্রমাণ করেছেন।

তিনি আরো বলেছেনঃ মালেক (রঃ)-এর অভিতম হলোঃ যখন কোন মুসলিম স্বয়ং কুফরী কালাম  দ্বারা যাদু করবে, তাকে হত্যা করা হবে, তাকে তাওবাহ করতে বলা হবেনা এবং তার তাওবাহ গ্রহণ করা হবে না। কেননা সে নাস্তিকদের মতো গোপনে একটি কাজ করছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা যাদুকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولاَ إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ
“এবং তারা উভয়ে কাউকেও এটা শিক্ষা দিতো না- এমনকি তারা বলতো যে, আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছুই নই, কাজেই তুমি কাফির হয়ো না” আর এটাই আহমাদ ইবনে হাম্বল, আবূ ছাওর, ইছহাক, শাফিয়ী এবং আবূ হানীফার অভিমত এবং উমার, উছমান, ইবনে উমার, হাফসাহ, আবূ মূসা, কাঈল ইবনে সা‘দ এবং সাতজন তাবিয়ী হতে যাদুকরকে হত্যা করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে

শাফিয়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছেঃ যাদুগরকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু যদি যাদুর দ্বারা কাউকে হত্যা করে এবং বলে আমি হত্যা করতে চেয়েছি। আর যদি বলে আমি তাকে হত্যা করতে চাইনি, তবে তাকে হত্যা করা হবে না, এতে ভুলক্রমে হত্যার ন্যায় রক্তপণ ওয়াজিব হবে। যদিও তাকে শিষ্টাচারের জন্য অন্যায়ের সমপরিমাণ প্রহার করা হবে।

ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ এটা দুই দিক দিয়ে বাতিলঃ
প্রথমঃ তিনি সুলাইমান (আঃ) যাদু শিক্ষা দেননি। যাদুর প্রকৃতরূপ হলো, এটা রচিত এমন কথা, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যকে সম্মান করা হয় এবং ওর দিকে ভাগ্য ও সৃষ্টিজগৎকে সম্পৃক্ত করা হয়।


দ্বিতীয়ঃ নিশ্চয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা স্বীয় কিতাবে স্পষ্টভাবে এটাকে কুফরী বলেছেন। তিনি বলেছেনঃ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ “সুলাইমান (আঃ) কুফরী করেনি”-অর্থাৎ যাদুর কথার মাধ্যমে। وَلَـكِنَّ الشَّيْاطِينَ كَفَرُواْ “কিন্তু শয়তানেরা কুফরী করেছে,” অর্থাৎ যাদুর মাধ্যমে এবং এটাকে শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে। আর হারুত ও মারুত ফেরেশেতাদ্বয় বলতেনঃ  إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ “আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছুই নই, কাজেই তুমি কাফির হয়ো না”-আর এটা বক্তব্যের গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
(আল-জামি লি আহকামিল কুরআন, ২/৩৪, ৪৭-৪৮)
শাইখ, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) ঈমান ধ্বংসকারী বিষয়সমূহ যা উক্ত ব্যক্তিকে মিল্লাত থেকে বের করে দেয়-এর মধ্যে একটি ‘যাদু’ এবং এর দ্বারা আমল করাকে উল্লেখ করেছেন।
(আর-রাসায়িলুশ-শাখছিয়াহ, ৬৯ পৃঃ)

এবং যাযিরাতুল আরব (আরব উপদ্বীপে) তাওহীদবাদী আলেমদের মধ্যে তাঁর সন্তান-সন্ততি ও পৌত্রগণ উক্ত বিষয়ে তার অনুসরণ করেছেন।
শাইখ ‘আল-ইকনা’ গ্রন্থের রচয়িতা হতে উল্লেখ করেছেনঃ যাদু শিক্ষা করা, শিক্ষা দেয়া এবং এর চর্চা করা হারাম। এটা শিক্ষা গ্রহণ করলে এবং চর্চা করলে তাকে কাফির আখ্যায়িত করা হবে। সে এটাকে হারাম বিশ্বাস করুক, কিংবা বৈধ বিশ্বাস করুক এতে কোন পার্থক্য হবে না। অতএব, আপনি উক্ত বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করুন!

(আর-রাসায়িলুশ-শাখছিয়াহ, ২১৩ পৃঃ)

Friday, May 30, 2014

কেয়ামতের লক্ষণ, দাজ্জাল, ঈসা (আঃ), ইয়াজুজ-মাজুজ...

আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহি নাহনাদুহু ওয়ানাস্তা ইনুহু ওয়ানাস্তাগফিরুহু ওয়ানা'উজুবিল্লাহিমিন সুরুরি আনফুচিনা ওয়ামিন চাই'ইয়াতি আ'মালিনা, মাইঈয়াহদিহিল্লাহু ফালা মুদিল্লালাহ ওয়ামাই উদিলিলহু ফালা হাদিয়ালাহ। ওয়াশহাদুয়াল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শরীকালাহু ওয়ানাশাহাদুয়ান্না মুহাম্মাদান আবদুহু রাসুলুহু।
আম্মা বাদ আউজুবিল্লা হিমিনাশশাইতনির রাজিম
.
বিসমিল্লাহির  রাহমানির  রাহিম .




সুবহা'নাল্লাহ ! এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সহীহ মুসলিমে একটা মাত্র হাদীস এতো বড়!
অনেক হাদীস গুলোকে এক সাথেই জানা যায় !!

বিভিন্ন ফিৎনা ও কিয়ামতের নিদর্শন::
সহিহ মুসলিম :: বই ৪১ :: হাদিস ৭০১৫ ।

নাওয়াস ইবন সামআন (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, একদা সকালে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করলেন । আলোচনা কালে তিনি কখনো আওয়াজ ছোট করলেন,
আবার কখনো আওয়াজ বড় করলেন । ফলে আমরা মনে করলাম যে, দাজ্জাল বৃক্ষরাজির এ ঝাড়ের মধ্যেই বুঝি এসে পড়েছে । অতঃপর আমরা সন্ধ্যায় আবার তাঁর নিকট গেলাম ।
তিনি আমাদের মাঝে এর কিছু আলামত দেখতে পেয়ে বললেন, তোমাদের কি অবস্হা ? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা) ! আপনি সকালে দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন
এবং এতে আপনি কখনো আওয়াজ ছোট করেছেন, আবার কখনো বড় করেছন । ফলে আমরা মনে করেছি যে, দাজ্জাল বুঝি এ ঝাড়ের মধ্যেই বিদ্যমান । এ কথা শুনে তিনি বললেন,
দাজ্জাল নয়, বরং তোমাদের ব্যাপারে অন্য কিছুর আমি অধিক আশংকা করছি । শোন, আমি তোমাদের মাঝে বিদ্যমান থাকা অবস্হায় যদি দাজ্জালের আবির্ভাব হয় তবে আমি নিজেই তাকে প্রতিহত করব ।
তোমাদের প্রয়োজন হবে না। আর যদি আমি তোমাদের মাঝে না থাকা অবস্হায় দাজ্জালের আবির্ভাব হয়, তবে প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি নিজের পক্ষ হতে একে প্রতিহত করবে ।
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আল্লাহ তাআলাই হলেন আমার পক্ষ হতে তত্ত্বাবধায়ক । দাজ্জাল যুবক এবং কোঁকড়া চুল বিশিষ্ট হবে । তার চক্ষু হবে স্ফীত আঙ্গূরের ন্যায় । আমি তাকে কাফির আবদুল উযযা ইবন কুতনের সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করছি ।
তোমাদের যে কেউ দাজ্জালের সময়কাল পাবে সে যেন সূড়া কাহফের প্রথমোক্ত আয়াত সমুহ পাঠ করে । সে ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যপথ হতে আবির্ভূত হবে । সে ডানে-বামে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে । হে আল্লাহর বান্দাগণ! অবিচল থাকবে ।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা) ! সে পৃথিবীতে কত দিন অবস্হান করবে ? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, চল্লিশ দিন পর্যন্ত। এর প্রথম দিনটি এক বছরের সমান, দ্বিতীয় দিন এক মাসের সমান এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের সমান হবে ।
অবশিষ্ট দিনগুলো তোমাদের দিনসমূহের মতই হবে । আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! যেদিন এক বছরের সমান হবে, উহাতে এক দিনের সালাতই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে ? জবাবে তিনি বললেন,
না, বরং তোমরা এদিন হিসাবে ঐ দিনের পরিমাণ নির্ধারণ করে নিবে । আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা) ! দাজ্জাল পৃথিবীতে কেমন করে চলবে ? তিনি বললেন, বাতাসে পরিচালিত মেঘের ন্যায় ।
সে এক সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদেরকে কুফরীর দিকে আহবান করবে । তারা তার উপর ঈমান আনহান করবে এবং তার ডাকে সাড়া দিবে । অতঃপর সে আকাশকে হুকুম করবে । আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে
এবং ভূমিকে নির্দেশ দিরে, ভূমি গাছ-পালা ও শষ্য উদগত করবে । এরপর সন্ধ্যায় তাদের গবাদী পশুগুলো পূর্বের তূলনায় অধিক লম্বা, কুজ, প্রশস্ত স্তন এবং উদরপূর্ণ অবস্হায় তাদের নিকট ফিরে আসবে ।
অতঃপর দাজ্জাল অপর এক সম্প্রদায়ের নিকট আসবে এবং তাদেরকে কুফুরীর প্রতি আহবান করবে । তারা তার কথাকে উপেক্ষা করবে । ফলে সে তাদের নিকট হতে ফিরে চলে যাবে । অমনি তাদের মাঝে
দুর্ভিক্ষ ও পানির অনটন দেখা দিবে এবং তাদের হাতে তাদের ধন-সম্পদ থাকবে না। তখন দাজ্জাল এক পতিত স্থান অতিক্রমকালে উহাকে সম্মোধন করে বলবে, তুমি তোমার গুপ্তধন বের করে দাও ।
তখন যমীনের ধন-ভাণ্ডার বের হয়ে তার চতূস্পার্শে একত্রিত হতে থাকবে, যেমন মধু মক্ষিকা তাদের সর্দারের চারিপাশে সমবেত হয় । তৎপর দাজ্জাল এক যুবক ব্যক্তিকে ডেকে আনবে এবং তাকে তরবারি
দ্বারা আঘাত করে তীরের লক্ষ্যস্হলের ন্যায় দু-ফাক করে ফেলবে । অতঃপর সে পূনরায় তাকে ডাকবে । যুবক দীপ্তমান হাস্যোজ্জল চেহারায় তার দিকে এগিয়ে আসবে । এ সময় আল্লাহ রাববুল আলামীন
মারইয়াম তনয় ঈসা (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন । তিনি দুই ফিরিশতার কাধের উপর ভর করে গোলানা রং এর জোড়া পরিহিত অবস্হায় দামেশক নগরীর পূর্ব দিকের শুভ্র মিম্বারের উপর অবতরণ করবেন ।
যখন তিনি তার মাথা ঝুঁকাবেন তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর শরীর থেকে গড়িযে পড়বে। তিনি যে কোন কাফিরের নিকট যাবেন সেই তাঁর শ্বাসের বাতাসে ধ্বংস হয়ে যাবে । তাঁর যতটৈ পর্যন্ত যাবে তাঁর শ্বাসও
ততাদূর পর্যন্ত পৌছবে । তিনি দাজ্জালকে তালাশ করতে থাকবেন । অবশেষে তাকে লুদ- নামক স্থানে গিয়ে পাকড়াও করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন । অতঃপর ঈসা (আঃ) ঐ সম্প্রদায়ের নিকট যাবেন,
যাদেরকে আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের ফিতনা থেকে হিফাযত করেছেন । তাদের নিকট গিয়ে তিনি তাদের চেহারায় হাত বুলিয়ে জান্নাতে তাদের স্থানসমূহ সম্পর্কে সংবাদ দিবেন ।
এমতাবস্হায় আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)-এর প্রতি এ মর্মে অহী নাযিল করবেন যে, আমি আমার বান্দাদেরকে নাযিল করেছি, যাদের সাথে কারোই যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই ।
সুতরাং তুমি তাদেরকে নিয়ে ভূর পর্বতে চলে যাও । তখন আল্লাহ তাআলা ইয়াজুয-মাযুয সম্প্রদায়কে প্রেরণ করবেন । তারা প্রতি উচু ভূমি হতে ছুটে আসবে । তাদের প্রথম দলটি তবরিস্তান সমুদ্রের নিকট এসে এর সমুদয় পানি পান করে নিঃশেষ করে দিবে ।
অতঃপর তাদের সর্বশেষ দলটি এ স্হান দিয়ে যাত্রাকালে বলবে, এ সমুদ্রে এক সময় অবশ্যই পানি ছিল । তারা আল্লাহর নবী (সা) ঈসা (আঃ) এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে অবরোধ করে রাখবে ।
ফলে তাদের নিকট একটি বলদের মাথা বর্তমানে তোমাদের নিকট একশ দীনারের মূল্যের চেয়েও অধিক মূল্যবান প্রতিপন্ন হবে । তখন আল্লাহর নবী (সা) ঈসা (আঃ) এবং তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবেন ।
ফলে আল্লাহ তা’আলা ইয়াজুয-মাজুজ সম্প্রদায়ের প্রতি আযাব প্রেরণ করবেন । তাদের ঘাড়ে এক প্রকার পোকা হবে । এতে একজন মানুষের মৃত্যুর ন্যায় তালাও সবাই মরে খতম হয়ে যাবে । অতঃপর ঈসা (আ) ও
তাঁর সঙ্গীগণ পাহাড় হতে যমীনে বেরিয়ে আসবেন । কিন্তু তারা অর্ধ হাত জায়গাও এমন পাবেন না যথায় তাদের পঁচা লাশ ও লাশের দুর্গন্ধ নেই । অতঃপর ঈসা (আঃ) এবং তাঁর সঙ্গীগণ পূনরায় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবেন ।
তখন আল্লাহ তাআলা উটের ঘাড়ের ন্যায় লহল এক ধরনের পাখি প্রেরণ করবেন । তারা তাদেরকে বহন করে আল্লাহর ইচ্ছা মাফিক স্থানে নিয়ে ফেলবে । এরপর আল্লাহ এমন মুষলধারে বৃষ্টি বর্যণ করবেন যার ফলে কাচা-পাকা কোন ঘরই আর বাকী থাকবে না ।
এতে যমীন বিধৌত হয়ে উদ্ভিদ শূন্য মৃত্তিকায় পরিণত হবে । অতঃপর পূনরায় যমীনকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হবে যে, হে যমীন! তুমি আবার মৃত্তিকায় পরিণত হবে। অতঃপর পুনরায় যমীনকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হবে যে, হে যমীন! তুমি আবার শস্য উৎপন্ন কর
এবং তোমার বরকত ফিরিয়ে দাও। সেদিন একদল মানুষ একটি ডালিম ভক্ষণ করবে এবং এর বাকলের নীচে লোকেরা ছায়া গ্রহণ করবে । দুধের মধ্যে বরকত হবে । ফলে দুগ্নবতী একটি উটই একদল মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে, দুগ্ধবতী একটি গাভী
একগোত্রীয় মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে এবং যথেষ্ট হবে দুগ্ধবতী একটি বকরী এক দাদার সন্তানের জন্য । এ সময় আল্লাহ তায়াআলা অত্যন্ত আরামদায়ক একটি বাতাস প্রেরণ করবেন । এ বাতাস সমস্ত ঈমানদার লোকদের বগলে গিয়ে লাগবে
এবং সমস্ত মুমিন মুসলিমদের রুহ কবয করে নিয়ে যাবে । তখন একমাত্র মন্দ লোকেরাই এ পৃথিবীতে বাকী থাকবে । তারা গাধার ন্যায় পরস্পর একে অন্যের সাথে ব্যাক্তিচারে লিপ্ত হবে । এদের উপরই কিয়ামত কায়িম হবে ।

Thursday, May 29, 2014

সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আহলে হাদীসদের দৃষ্টিভঙ্গি


আলহামদুলিল্লাহ্‌ ওয়াস সালাতু আসসালাম ওয়ালা সা'ঈদেনা আলা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলিহী ওয়া আসসাহাবী আসাল্লাম তাসলিমান কাসিরা।।আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
আচ্ছালামুয়ালাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারকাতুহু।


সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা ও সম্মান সস্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বিস্তারিত বর্ণনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের একটা শিশুও সাহাবায়ে-কেরামের মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন। সাহাবায়ে কেরাম রা. যেমন ছিলেন সত্যের মাপকাঠি, তেমনি তারা দুনিয়া থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টির ঘোষণাপ্রাপ্ত। ইসলামের সঠিক পথ নির্ণয়ের মাপকাঠি হলো, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর অনুসৃত পথের অনুসরণ। যুগে যুগে যারাই সাহাবায়ে কেরাম রা. এর পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছে, তারাই গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী হলেন সাহাবায়ে কেরাম। যারা সাহাবায়ে কেরামকে যথাযথ সম্মান করে, তাদের অনুসৃত পথে চলে,তারাই মুলত: কুরআন ও সুন্নাহের প্রকৃত অনুসারী। সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথ ব্যতীত লক্ষ-কোটি বারও কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণের দাবী করলেও তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট।

যুগে যুগে যারা সাহাবায়ে কেরামের বুঝকে পায়ে দলে, তাদের অনুসৃত পথকে দূরে সরিয়ে নিজেদের মনগড়া মতবাদ চালু করেছে, তারাই মুলত: ভ্রষ্টতার গভীরে নিমজ্জিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা না দিয় যারা তাদের সমালোচনা করেছে, তারাই যুগে যুগে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সুতরাং হক ও বাতিলের পরিচয়ের জন্য আমাদের বিস্তর গোবেষণার প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, আমরা দেখবো, কারা রাসূল স. এর সাহাবাদের অনুসৃত পথে চলে। যারা কুরআন ও সুন্নাহকে সাহাবায়ে কেরাম এর বুঝ অনুযায়ী অনুসরণ করে তারাই মুলত: মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত দল। এর বাইরে যতো দল, মত বা মতবাদ রয়েছে, সবগুলোই ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী।

একবার মোনাজেরে জামান হযরত মাওলানা আমীন সফদর রহ. এর কাছে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলো, জামাতে ইসলাম বা মাওলানা মওদুদী ও দেওবন্দী আলেমদের মাঝে পার্থক্য কী?
তিনি তাকে বললেন, হায়াতুস সাহাবা বইটি নিয়ে যান। এক সপ্তাহ পড়ার পর আমার কাছে আসবেন।
লোকটি এক সপ্তাহ পরে আবার এলো। আমীন সফদর রহ. তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই এক সপ্তাহে হায়াতুস সাহাবা পড়ে কী শিখেছেন?
লোকটি বলল, বইটি পড়ে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা ও মহব্বত বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। তাদের প্রতি সীমাহীন ভক্তি ও শ্রদ্ধা জন্ম নিয়েছে।
আমীন সফদর রহ. বললেন, এবার আপনি মাওলানা মওদুদী সাহেবের লেখা খেলাফত ও মুলুকিয়াত বইটা নিয়ে যান। এক সপ্তাহ বইটা পড়ে আমাকে প্রতিক্রিয়া জানাবেন।

লোকটি এক সপ্তাহ পরে এসে বলল, এই বই পড়ে তো সাহাবায়ে কেরামের প্রতি অন্তরে ঘৃণাবোধ তৈরি হয়েছে। তাদের সমালোচনা ও দোষত্রুটিই শুধু চোখে ভাসে।
আমীন সফদর রহ. বললেন, এটিই হলো দেওবন্দ ও মাওলানা মওদুদীর মাঝে পার্থক্য।
বর্তমান আহলে হাদীসদের সাথে আমাদের বিরোধ শুধু শাখাগত মাসআলা নিয়ে নয়। বরং এদের সাথে আমাদের বিরোধ মৌলিক আকিদা বিষয়ে। এদের সাথে আমাদের বিরোধ সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ ও তাদের মর্যাদা বিষয়ে। আহলে হাদীসদের সাথে আমাদের বিরোধকে যারা একান্ত শাখাগত মাসআলা কেন্দ্রিক মনে করে থাকেন, তারা মারাত্মক ভুলের মধ্যে রয়েছেন। আহলে হাদীসদের সাথে আমাদের অধিকাংশ বিরোধ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মৌলিক আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কিত। আমাদের এই সিরিজে সাহাবায়ে কেরাম রা. সম্পর্কে আহলে হাদীসদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।



পবিত্র কুরআনে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা:

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সাহাবায়ে কেরাম রা. এর প্রশংসা করেছেন। তাদের মর্যাদা ও অবস্থান তুলে ধরেছেন।

১. আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿১০০﴾ سورة التوبة

‘মুহাজির ও আনসারদের প্রথম অগ্রবর্তী দল এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটাই মহা সাফল্য’

[সূরা তওবা-১০০]

২. আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন:
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآَزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا ﴿২৯﴾ سورة الفتح

‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্ট কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদার প্রভাবের চিহ্ন পরিস্ফুট থাকবে। তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপ। আর ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা হল যেমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অত:পর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন।

[সূরা আল Ñ ফাতহ, ২৯। ]


৩. অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ ﴿৮﴾ وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ﴿৯﴾ سورة الحشر

‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরগণের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। তারাই সত্যবাদী। আর এ সম্পদ তাদের জন্যও, যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করেছে এবং ঈমান এনেছে। তারা মুহাজিরদেরকে ভাল-বাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তার জন্য তারা অন্তুরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।

[সূরা-হাশর, ৮-৯]

৪. অপর জায়গায় এরশাদ হয়েছে–
لَّقَدْ رَضِيَ اللَّـهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লহ তায়া’লা ঐ সকল মুসলমানদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন (যাহারা আপনার সফর সঙ্গী), যখন তাঁহারা আপনার সাথে গাছের নিচে অঙ্গীকার করছিলো এবং তাঁদের অন্তরে যা কিছু (ইখলাস ও মজবুতি) ছিল তাও আল্লহ তায়া’লার জানা ছিল, আর আল্লহ তায়া’লা তাঁদের অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন এবং তাদেরকে একটি নিকটবর্তী বিজয় দান করলেন। (এর দ্বারা খায়বরের বিজয় কে বুঝানো হয়েছে, যা একেবারে নিকটবর্তী সময়ে হয়েছে) আর প্রচুর গনিমতও দান করলেন।

(সূরা ফাতহঃ ১৮)


৫. সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের ব্যাপারে আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করেন–
مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّـهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا

অর্থঃ ঐ সকল মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা আল্লহর সাথে যে ওয়াদা করেছিলো তাতে সত্য প্রমানিত হয়েছে। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা নিজ মানত পূর্ণ করেছে (অর্থাৎ শহীদ হয়ে গিয়েছে।) আর কিছু তাদের মধ্য হতে এর জন্য আগ্রহী এবং অপেক্ষায় আছে (এখনও শহীদ হয়নি) এবং নিজেদের ইচ্ছার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন ও রদ-বদল ঘটায়নি। (সূরা আহযাবঃ ২৩)


৬. সূরা নিসার ৯৫নং ও সূরা হাদীদের ১০নং আয়াতে সাহাবায়ে কেরামের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وكلا وعد الله الحسنى

অর্থাৎ, তাদের (মধ্যে পারস্পরিক তারতম্য থাকা সত্ত্বেও) সবাইকে আল্লাহ তা‘আলা হুসনা তথা উত্তম পরিণতির (জান্নাত ও মাগফিরাতের) ওয়াদা দিয়েছেন।
এ আয়াতে আল্রাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের জন্য হুসনা এর ওয়াদা করেছেন।সূরা আম্বিয়ার ১০১নং আয়াতে হুসনা লাভকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, إن الذين سبقت لهم منا الحسنى أولئك عنها مبعدون অর্থাৎ, যাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে পূর্বেই হুসনার ওয়াদা হয়ে গেছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে।


৭. সূরা হুজুরাতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
o لكن الله حبب إليكم الإيمان و زينه في قلوبكم و كره إليكم الكفر و الفسوق و العصيانط أولئك هم الراشدون

অর্থাৎ, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পান্তরে কুফর, শিরক, পাপাচার ও নাফরমানির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই (সাহাবীগণ) সৎপথ অবলম্বনকারী।

[সূরা হুজুরাত-৮]

৮. সূরা হুজুরাতের ১৫ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
oإنما المؤمنون الذين امنوا بالله و رسوله ثم لم يرتابوا و جهدوا بأموالهم و أنفسهم في سبيل اللهط أولئك هم الصدقون

অর্থাৎ, তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে। তারাই (সাহাবীগণ) সত্যনিষ্ঠ (বা সত্যবাদী)।

[সূরা হুজুরাত-১৫]

৯. আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের ঈমানকে মাপকাঠি সাব্যস্ত করে বলেছেন,

فإن امنوا بمثل ما امنتم به فقد اهتدوا و إن تولوا فإنما هم في شقاق

অর্থাৎ, যদি তারা ঈমান আনে, যেরূপ তোমরা ঈমান এনেছ, তবে তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা (এথেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা হঠকারিতায় রয়েছে।

[সূরা বাক্বারা-১৩৭]

১০. সাহাবায়ে কেরাম এর ইমানের গ্রহণযোগ্যতা এবং যারা সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে উপহাস করেছে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
oو إذا قيل لهم امنوا كما امن الناس قالوا أنؤمن كما امن السفهاء ألا إنهم هم السفهاء و لكن لا يعلمون

অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয়, মানুষরা অর্থাৎ সাহাবীরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন। তখন তারা বলে আমরাও কি বোকাদের মতো ঈমান আনব? মনে রেখো প্রকৃতপে তারাই বোকা; কিন্তু তারা তা বোঝে না।

[সূরা বাক্বারা-১৩]

১১. সূরা আনফালে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
oأولئك هم المؤمنون حقا لهم درجت عند ربهم و مغفرة و رزق كريم

অর্থাৎ, এমন সব লোকই (সাহাবীরা) সত্যিকারের মুমিন (যাদের ভেতর ও বাহির এক রকম এবং মুখ ও অন্তর ঐক্যবদ্ধ)। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদিগারের নিকট সুউচ্চ মর্যাদা ও মাগফিরাত এবং সম্মানজনক রিয্ক। [সূরা আনফাল-৪]


১২. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

وألزمهم كلمة التقوى وكانوا أحق بها

অর্থাৎ, (আল্লাহ তা‘আলা) তাদের (অর্থাৎ সাহাবীদের) জন্য কালিমায়ে তাক্বওয়া তথা সংযমের দায়িত্ব অপরিহার্য করে দিলেন। বস্তুতঃ তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত।

(সূরা ফাত্হ-২৬)

  • রাসূল স. এর হাদীসে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা: 

     

     ১. বোখারী-মুসলিমের সহীহ হাদীসে রয়েছে,

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : خير أمتي قرني ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم

হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রসূল (স.) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম তারা যারা আমার যুগে রয়েছে। অতঃপর তাদরে পরবর্তী যুগের উম্মাত (তথা তাবেয়ীগনের যুগ) অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের উম্মাত। (অর্থাৎ, তাবয়ে তাবেয়ীনের যুগ) (বুখারী ৪/২৮৭- ২৮৮- মুসলিম ৪/১৯৬৪)


২. সাহাবাদের মর্যাদা সম্মন্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেনঃ

الله الله فى أصحابى لا تتخذوهم غرضا من بعدى فمن أحبهم فبحبى أحبهم ومن أبغضهم فببغضى أبغضهم
অর্থাত-সাবধান!তোমরা আমার সাহাবীগণের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। আমার পরে তোমরা তাঁদেরকে (তিরস্কারের) লক্ষ্যবস্তু বানাইও না। যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে সে আমার প্রতি ভালোবাসা বশেই তাঁদেরকে ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে সে আমার প্রতি বিদ্বেষবশতঃ তাঁদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে”।(তিরমিযী-৩৮৬১, ইবনে হিব্বান, হা. ২২৮৪, মুসনাদে আহমদ, খ.৪, পৃ.৮৭, আস-সুন্নাহ, ইবনে আবি আসেম, হা.৯৯২)

৩. তিনি আরো ইরশাদ করেছেনঃ

لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ
অর্থাত-তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিওনা। তোমাদের মধ্যে যদি কেহ উহুদ সমপরিমাণ স্বর্ণও যদি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে,তবেও তাঁদের এক মুদ্দ বা তার অর্ধেক পরিমাণ(এক মুদ=১ রতল। আল্লামা শামী(রাঃ)বয়ান করেছেন যে, এক মুদ্দ ২৬০ দিরহামের সমপরিমাণ। দ্রষ্টব্যঃ আওযানে শরিয়্যাহ)আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার সমতূল্য হবেনা।
(সহি বুখারী-হাদিস নং ৩৭১৭)

৪. হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ)হতে বর্ণিতঃ রাসুলুলুল্লাহ(সঃ) ইরশাদ করেছেন- ” من سب اصحابي فعليه لعنة الله والملائكة والناس اجمعين ” .

অর্থাৎ -“যারা আমার সাহাবীদেরকে গালী দেয়, তাদের প্রতি আল্লাহর,ফেরেস্তাদের,এবং জগতবাসীর অভিশাপ বর্ষিত হোক।
(তাবরানী ফিল কাবির, হা.১২৭০৯)

৪. হযরত উমর রা. থেকে বর্ণিত রাসূল স. বলেন,

اكرموا أصحابى فإنهم خياركم
অর্থাৎ-তোমরা আমার সাহাবীগণকে সম্মান কর। কেননা তাঁহারা তোমাদের মধ্যকার উত্তম মানব।
[মুসনাদে আহমাদ, খ.১, পৃ.১১২, তাহকীক, আহমাদ শাকের, নাসায়ী, হাকেম, মেশকাত, খ.৩, পৃ.১৬৯৫]

৫. হযরত আবু বুরদাহ(রাঃ) হতে বর্ণিত যে,রাসুলুল্লাহ(সঃ) ইরশাদ করেছেন যে

عن أبى بردة رضي الله عنه قال : قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم – النجوم أمنة للسماء فإذا ذهبت النجوم أتى السماء ما توعد ، وأنا أمنة لأصحابي فإذا ذهبت أتى أصحابي ما يوعدون ، وأصحابي أمنة لأمتي فإذا ذهب أصحابي أتى أمتي ما يوعدون.
অর্থঃ নক্ষত্র সমুহ আসমানের জন্য আমানত স্বরুপ। যখন নক্ষত্রগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাবে,তখন আসমানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কেয়ামত চলে আসবে। এবং আমি আমার সাহাবীদের জন্য আমানত স্বরুপ। অতএব যখন আমি ইহকাল ত্যাগ করব তখন তাঁদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁদের(সাহাবাদের) মধ্যে ইজতেহাদি মতানৈক্য দেখা দিবে। এবং আমার সাহাবীরা উম্মতের জন্য আমানত স্বরুপ। অতএব যখন তাঁদের যুগের অবসান ঘটবে তখন আমার উম্মতের মধ্যে বিভিন্ন রকমের ফেতনা-ফ্যাসাদের সুত্রপাত ঘটবে। [মুসলিম শরীফ, হা.২৫৩১]

৬. ইরবায ইবনে সারিয়া(রাঃ)হতে বর্ণিত যে,রাসুলুল্লাহ(সাঃ)ইরশাদ করেছেনঃ তোমরা

قال النبى صلى الله عليه وسلم: عليكم بسنتى وسنة خلفاء الراشدين المهدين
অর্থঃ আমার এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীন রা. এর সুন্নতকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে।
(আবু দাউদ হা.৪৬০৭,তিরমিযী-২৮৯১,ইবনে মাজা [ভূমিকা, ৪২], মুসনাদে আহমদ হা.১৭৬০৬, মুসনাদে বাযযার,ইবনে হিব্বান,মুসতাদরাক লিল-হাকিম,তারীখে দিমাশক লি-ইবনে আসাকির, আল-মু’জামুল কাবীর, হা. ৬২৩, আল-আওসাত, আল-কাবীর লিত্তাবরানী)

৭. রাসুলে কারীম(সাঃ) সমস্ত উম্মতকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলে গেছেনঃ

ستفترق أمتى ثلاثا وسبعين فرقة كلهم فى النار إلا واحدة : قالوا من هى يا رسول الله! قال: ما أ نا عليه وأصحابى
অর্থঃ“ অতিশীঘ্র আমার উম্মত তেহাত্তর(৭৩) ফের্কায় বিভক্ত হয়ে পড়বে। তন্মধ্যে মাত্র একটি দলই মুক্তিপ্রাপ্ত এবং জান্নাতী হবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেনঃ সেই মুক্তিপ্রাপ্ত সৌভাগ্যশালী দলটি কারা এবং এত বড় সৌভাগ্য লাভের ভিত্তি কোন নীতি বা আদর্শের উপর ? উত্তরে নবী(সাঃ) বললেন,যে নীতি,তরীকা ও আদর্শের উপর আমি এবং আমার সাহাবায়ে কেরাম আছেন।(তিরমিজী শরীফ, হা.২৬৪০, ইবনে মাজা, হা.৪৭৯, মুসনাদে আহমদ খ.৪, পৃ.১০২, আল-মুসতাদরাক, খ.১, পৃ.১২৮)

৮. হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত রাসূল স. বলেন,

آية الإيمان حب الأنصار ، وآية النفاق بغض الانصار
অর্থ: ঈমানের নিদর্শন হলো, আনসারী সাহাবীদের মহব্বত এবং মুনাফেকীর নিদর্শন হলো, আনসারীদের প্রতি বিদ্বেষপোষণ।
[ বোখারী শরীফ, খ.৭, পৃ.১১৩, মুসলিম শরীফ, হা.৭৪, ইমান অধ্যায়]

৯. রাসূল স. ইরশাদ করেন,

لا تزالون بخير ما دام فيكم من رآني وصحبني، والله لا تزالون بخير ما دام فيكم من رأي من رآني وصاحبني
অর্থ: তোমরা ততোদিন পর্যন্ত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতক্ষণ তোমাদের মাঝে আমাকে যারা দেখেছে এবং আমার সংস্পর্শে থেকেছে তারা বর্তমান থাকবে। আল্লাহর শপথ, তোমরা কল্যানের মাঝে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের মাঝে এমন লোক থাকবে, যারা আমার সাহাবী ও সংস্পর্শ অবলম্বনকারীদেরকে দেখেছে।
[মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, খ.১২, পৃ.১৭৮, ত্ববরানী ফিল কাবির, খ.২২, পৃ.৮৫, ফাতহুল বারী, খ.৫, পৃ.৭]

সাহাবায়ে কেরাম রা. এর সমালোচনার ভয়ঙ্কর পরিণতি:

ইমাম মালেক রহ. বলেন,

إنما هؤلاء أقوام أرادوا القدح في النبي صلى الله عليه وسلم فلم يمكنهم ذلك ، فقدحوا في أصحابه حتى يقال رجل سوء و لو كان رجلاً صالحاً لكان أصحابه صالحين
অর্থ: যারা সাহাবাদের ব্যপারে কুৎসা রটনা করে এবং তাদেরকে গালি দেয় এরা মূলত: রসূল (স.) এর বিরুদ্ধেও কুৎসা রটাতে চেয়েছিলো, কিন্তু তাদের দ্বারা তা সম্ভব হয়নি। তাই তারা সাহাবাগণের ব্যাপারে মিথ্যা রটিয়েছে এবং বলেছে, অমুক সাহাবী নিকৃষ্ট লোক ছিল, অমুকে এমন ছিল তেমন ছিল ইত্যাদি। রাসূল স. যদি নেককার ও সৎ হয়ে থাকেন, তবে তাদের নিকট তার সাহাবীরাও সৎ ও নেককার বিবেচিত হতো।
(আস-সরিমূল মাসলূল, পৃ. ৫৫৩)

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন,

إذا رأيت رجلا يذكر أحدا من الصحابة بسوء فاتهمه على الإسلام
অর্থাৎ যদি কাউকে রাসূল স. এর কোন সাহাবীর সমালোচনা করতে দেখো, তবে তার ইসলামের ব্যাপারে সংশয় পোষণ করো।
[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৮, পৃ.১৪২]

আবূ যুর'আ রহ. বলেন,

فإذا رأيت الرجل ينتقص أحدا من اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فأعلم انه زنديق، وذلك ان الرسول صلى الله عليه وسلم عندنا حق، والقرآن حق، وإنما أدى إلينا هذا القرآن والسنة أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، وإنما يريدون أن يجرحوا شهودنا ليبطلوا الكتاب والسنة، والجرح بهم اولى وهم زنادقة

¤ বলেন, তোমরা যখন কাউকে কোন সাহাবীর অবমাননা করতে দেখ, তখন বিশ্বাস করে নাও যে, সে যিন্দীক ও বির্ধমী। তা এ জন্য যে, আমাদের নিকট রাসূল স. সত্য নবী, পবিত্র কুরআন সত্য; কুরআন হাদীস তথা পুরা দ্বীন যা আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে, তার প্রথম যোগসূত্র হলেন সম্মানিত এ জামাত। সুতরাং যে ব্যক্তি সাহাবাগণের সমলোচনা করবে, সে আমাদের বিশ্বস্ত সাক্ষীদের সমালোচনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ দ্বীনকেঅগ্রাহ্য বলে ঘোষণা করতে চায়। অর্থাত্ ইসলামের মূলভিত্তি ধ্বংস করে দিতে চায়। সুতরাং এজাতীয় লোকদের সমালোচনা করা উত্তম বরং এরা হলো যিন্দিক।
[আল-কিফায়া, খতীব বাগদাদী, পৃ.৯৭]

¤ ইমাম আবূ আমর ইবনুস সালাহ রহ. বলেন, কুরআন হাদীস ও উম্মতের ইজমা হতে এ বিষয়টি সিদ্ধান্তকৃত যে, কোন সাহাবী রাযি. এর পূত- পবিত্রতা সম্পর্কে প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই।

- উলূমুল হাদীসঃ ২৬৪

¤ ইমাম ইবনে হুমাম রহ. বলেন-

আহলুস-সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতের আকীদা হল, সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম রাযি. কে পূত ও পবিত্র মনে করা, তাঁদের উপর আপত্তি উত্থাপন থেকে বেঁচে থাকা এবং তাদের প্রশংসা করা ওয়াজিব।
মুসায়েরা- ১৩২পৃঃ

¤ সকল সাহাবা রাযি. এর

সঙ্গে ভালবাসা পোষণ করা এবং তাঁদের মাঝে পারস্পরিক যে সকল ঘটনা সমূহ সংঘটিত হয়েছে তা লিখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা, শ্রবণ
করা এবং করানো হতে বিরত
থাকা এবং তাঁদের সুনাম
সুখ্যাতি আলোচনা করা, তাঁদের
প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা এবং তাঁদের প্রতি ভালবাসা রাখা, তাঁদের প্রতি কোন প্রকার আপত্তি প্রর্দশন থেকে বেচে থাকা ফরয।
(শরহে আকীদায়ে সাফারানীঃ ২/৩৮৬)

  • সাহাবীগণের সমালোচনাকারীদের সম্পর্কে সালাফে-সালেহীনের অবস্থান:

সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনাকারীদের সম্পর্কে সালাফে-সালেহীনের কিছু বক্তব্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ইমামের অনেক বক্তব্য রয়েছে। সালাফে-সালেহীনের এসব বক্তব্যের সারমর্ম নিচে উল্লেখ করা হলো,
১. সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে গালি দেয়া, তাদের সম্পর্কে অশোভনীয় ভাষা ব্যবহার, তাদের সমালোচনা, তাদের ব্যাপারে কুৎসা রটনা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। এজাতীয় কাজের কারণে একজন মুসলিম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হয়ে পথভ্রষ্ট ফেরকার অন্তর্ভূক্ত হয়।
২. সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা, তাদের প্রতি কুধারণা, এবং তাদের কুৎসা রটনা করা বিধর্মী যিন্দিকদের কাজ।
৩. সাহাবায়ে কেরাম রা. সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা ওয়াজিব।
৪. সর্বদা সাহাবায়ে কেরাম রা. এর ভালো গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা উচিৎ।
৫. সব সাহাবীই রাসূল স. এর প্রিয় ছিলেন।
৬. সাহাবায়ে কেরাম রা. এর সমালোচনাকারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা জরুরি।
৭. অনেক সময় সাহাবীদেরকে গালা-গালি করার কারণে মানুষ ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।
৮. সাহাবায়ে কেরাম রা. এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের শর্ত ও চাহিদা, তাদের প্রতি বিদ্বেষ বেইমানীর আলামত।

  • সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে কাজী শাওকানী ও নওযাব সিদ্দিক হাসান খানের জঘন্য বক্তব্য:

এ পর্বে আহলে হাদীসদের বিখ্যাত দুই গুরুর বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
হযরত ত্বলহা ও যোবায়ের রা. এর ব্যাপারে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ:
কাজী শাওকানী ওবালুল গামাম নামে একটি কিতাব লিখেছেন। কিতাবটি তাহকীক করেছেন, মুহাম্মাদ সাবহী হাসান হাল্লাক। এটি প্রকাশ করেছে, মাকতাবাতুল ইলম, জিদ্দা ও মাকতাবায়ে ইবনে তাইমিয়া, কায়রো।
প্রথম প্রকাশ, ১৪১৬ হি:

ওবালুল গামামের দ্বিতীয় খন্ড, পৃ.৪১৪-৪১৫ পৃষ্ঠায় হযরত ত্বলহা ও হযরত যুবায়ের রা. সম্পর্কে কাজী শাওকানী লিখেছে,

أما طلحة والزبير ومن معهم , فلأنهم قد كانوا بايعوه , فنكثوا بيعته بغياً عليه , وخرجوا في جيوش من المسلمين , فوجب قتاله
অর্থ: ত্বলহা, যোবায়ের ও তাদের সাথীরা যেহেতু হযরত আলী রা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন, অত:পর তার সাথে বিদ্রোহ করে তার বাইয়াত ভঙ্গ করেছে এবং মুসলমানদের একটি সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছে, সুতরাং তাদের সাথে হযরত আলী রা. এর যুদ্ধ করা ওয়াজিব হয়ে গেছে।

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,


হযরত মুয়াবিয়া রা. সম্পর্কে কাজী শাওকানীর জঘন্য বক্তব্য:

কাজী শাওকানী ওবালুল গমাম বইয়ে সিফফীনের যোদ্ধাদেরকেও রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করেছে। অথচ সিফফীনের যুদ্ধে হযরত মুয়াবিয়া রা. এর সাথে আরও অনেক সাহাবীও ছিলেন। এছাড়া হযরত মুয়াবিয়া রা. সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছে, এতে আমাদের গা শিউরে উঠে। কাজী শাওকানী লিখেছে,

وأما أهل صفين , فبغيهم ظاهر , ولو لم يكن في ذلك إلا قوله صلى الله عليه وآله وسلم لعمار: ((تقتلك الفئة الباغية)) , لكان ذلك مفيداً للمطلوب , ثم ليس معاوية ممن يصلح لمعارضة علي , ولكنه أراد طلب الرياسة والدنيا بين فوم أغتام , لا يعرفون معروفاً ولا ينكرون منكراً , فخادعهم بأنه طالب بدم عثمان , فنفق ذلك عليهم , وبذلوا بين يديه دماءهم وأموالهم , ونصحوا له

অর্থ: সিফফীনের যোদ্ধাদের রাষ্ট্রদ্রোহীতা সুস্পষ্ট। বাস্তবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী না হলেও হযরত আম্মারের সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণে যথেষ্ঠ ছিলো। রাসূল স. বলেছেন, তোমার সাথে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী দল যুদ্ধ করবে। এছাড়া মুয়াবিয়া হযরত আলীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যও ছিলো না। বরং সে শামের মূর্খদের মাঝে নেতৃত্ব ও সম্পদের আকাংখী ছিলো। এই মূর্খরা সৎকাজকে সৎ ও নিকৃষ্ট কাজকে নিন্দনীয় মনে করতো না। মুয়াবিয়া এই শামের অধিবাসীদেরকে এই বলে ধোকা দিয়েছে যে, সে হযরত উসমান রা. এর রক্তের বদলা নিতে চায়। এভাবে তাদের সাথে সে মুনাফেকী করেছে। ফলে শামের অধিবাসীরা তার সামনে তাদের রক্ত ও সম্পদ বিসর্জন দিয়েছে, তার কল্যাণ কামনা করেছে।

কাজী শাওকানী শুধু হযরত মুযাবিয়া রা. এর সমালোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, মুয়াবিয়া রা. এর সহযোগী অন্যান্য সাহাবাযে কেরাম সম্পর্কে তার বক্তব্য দেখুন,

وليس العجب من مثل عوام الشام , إنما العجب ممن له بصيرة ودين , كبعض الصحابة المائلين إليه , وبعض فضلاء التابعين , فليت شعري أي أمرٍ اشتبه عليهم في ذلك الأمر , حتى نصروا المبطلين وخذلوا المحقين , وقد سمعوا قول الله تعالى: ((فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ)) , وقد سمعوا الأحاديث المتواترة في تحريم عصيان الأئمة ما لم يروا كفراً بواحاً , وسمعوا قول النبي صلى الله عليه وآله وسلم لعمار: انها تقتله الفئة الباغية . ولولا عظيم قدر الصحبة ورفيع فضل خير القرون , لقلت : حب الشرف والمال قد فتن سلف هذه الأمة كما فتن خلفها
 

অর্থ: শামের সাধারণ মানুষের ব্যাপারে এতোটা বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু সেসব লোকদের ব্যাপারে বিস্মিত হই, যাদের দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো, যারা বিচক্ষণ ছিলেন, যেমন, মুয়াবিয়ার পক্ষ অবলম্বনকারী কিছু সাহাবী, বিশিষ্ট কিছু তাবেয়ী। হায়, আমি বুঝতে পারি না, কী কারণে তারা এজাতীয় সন্দেহের আবর্তে নিমজ্জিত হলেন; এমনকি তারা বাতিলের সাহায্য করলেন এবং সত্যকে লান্ছিত করলেন? অথচ তারা আল্লাহর এই বাণী শুনেছিলো: [অর্থ] যদি তাদের একদল অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে সেই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যে বাড়াবাড়ি করে, যতক্ণণ না তারা আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে।(হুজুরাত-৯)
তারা হযরত আম্মার বিন ইয়াসি রা. এর উদ্দেশ্যে রাসূল স. এর এ উক্তিও শুনেছিলো, [অর্থ:] তোমার সাথে রাষ্ট্রদ্রোহী একটি দল যুদ্ধ করবে। যদি সাহাবীদের উচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠ তিন যুগের উচ্চ ফজিলত না থাকতো, তাহলে আমি বলতাম: সম্পদ ও পদের লোভ এই উম্মতের পূর্ববর্তীদেরকে যেমন ফেতনায় ফেলেছে, তেমনি পরবর্তীদেরকেও। [শাওকানীর বক্তব্য শেষ হলো]

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,



বিজ্ঞ পাঠক: কাজী শাওকানী সাহাবীদের মর্যাদার প্রতি লক্ষ রেখে (?) যা বলেছে তাতে এই অবস্থা, যদি তিনি এই মর্যাদার প্রতি লক্ষ না করতেন, তাহলে না জানি কত কী বলতেন? আল্লাহ পাক সাহাবাদের সম্পর্কে এধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ থেকে আমাদেকে হেফাজত করুন।
হযরত মুয়াবিয়া রা. সম্পর্কে যেসব জঘন্য বক্তব্য কাজী শাওকানী লিখেছে,
১. পদ ও সম্পদের লোভ
২. হযরত উসমান রা. রক্তের বদলা নেয়ার কথা বলে ধোকাবাজি।
৩. বাতিল।

কাজী শাওকানীর ওবালুল গামাম এর লিংক:



আহলে হাদীস আলেম নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান:
কাজী শাওকানী আদ-দুরারুল বাহিয়্যা নামে একটি কিতাব লেখেন। কাজী শাওকানীর ছাত্র আহলে হাদীসদের বিশিষ্ট আলেম নওযাব সিদ্দিক হাসান খান এই কিতাবের একটি ব্যাখ্যা লেখেন। সিদ্দিক হাসান খানের এই ব্যাখ্যার নাম হলো, আর-রওজাতুন নাদিয়্যা। কিতাবটি আহলে হাদীসদের সিলেবাসভুক্ত একটি কিতাব। সালাফীদের শেইখ আলবানী দীর্ঘ দিন এই কিতাবের দরস দিয়েছে। শায়খ আলবানী আর-রওজাতুন নাদিয়্যার সংক্ষিপ্ত একটি ব্যাখ্যা লিখেছে।আলবানীর এই ব্যাখ্যার নাম হলো, আত-তা’লিকাতুর রজিয়্যা।



কিতাবটির প্রথম সংস্করণ ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। দারু ইবনিল কাইয়্যিম ও দারু ইফফান নামক দু’টি লাইব্রেরী এটি প্রকাশ করেছে। কিতাবটি তাহকীক করেছে, আলবানী সাহেবের বিশিষ্ট ছাত্র আলী আল-হালাবী। আমাদের আলোচ্য বিষয় এ কিতাবের তৃতীয় খন্ডের ৫০১ পৃষ্ঠা থেকে পরবর্তী আলোচনায় রয়েছে। নিচের স্ক্রিনশট লক্ষ্য করুন। যারা আরও বিস্তারিত অনুসন্ধানে আগ্রহী, তারা মূল কিতাবটি নিচের লিংক থেকে ডাউনলোড করে নিবেন।
কিতাবের লিংক:


আর-রওজাতুন নাদিয়্যাতে নওয়াব সিদ্দিক হাসান খানও কাজী শাওকানীর উক্ত বক্তব্য হুবহু উল্লেখ করেছে। নওয়াব সাহেব এসব বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ করেননি। বরং এগুলো তিনি যত্নসহকারে তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এই বক্তব্যগুলো মূলত: সিদ্দিক হাসান খানের উস্তাদ কাজী শাওকানীর। মূল কিতাব আদ-দুরারুল বাহিয়্যাতে এই বক্তব্যগুলো ছিলো না। নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান তার ব্যাখ্যায় এই বক্তব্যগুলো উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম ও হযরত মুয়াবিয়া রা. সম্পর্কে কাজী শাওকানী ও নওযাব সিদ্দিক হাসান খানের বক্তব্য একই। উস্তাদ ও শাগরেদ একই পথের পথিক। আসলে তারা কোন পথের পথিক ছিলো? শিয়াদের পথের পথিক ছিলো। কাজী শাওকানী নিজে যায়দী শিয়া ছিলো। তার অনুসারী আহলে হাদীস নওয়াব সিদ্দিক হাসানও এর বাইরে যেতে পারেনি।



উক্ত বক্তব্য উল্লেখের পর শায়খ মুহাম্মাদ আহমাদ শাকের সাহেব নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান সম্পর্কে লিখেছে,

و قد غلب علي الشارح ما يغلب علي الأعجام من التشيع
“ব্যাখ্যাকার নওয়াব সিদ্দিক হাসানের মাঝে মূর্খ অনারবীদের মতো শিয়াদের প্রভাব জেকে বসেছে”

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

এই বক্তব্যগুলো সম্পর্কে আলবানী সাহেবের কোন মন্তব্য আত-তা’লীকাতুর রজিয়্যাতে নেই। এর কারণ আমদের অজানা।

আল্লাহ পাক আমাদের সাহাবায়ে কেরামের সমালোচক ও সাহাবা-বিদ্বেষীদের থেকে হেফাজত করুন। সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে সাহাবা বিদ্বেষীদের থেকে হেফাজত করুন।
আমীন।
 


Tuesday, May 27, 2014

ইমাম মাহদির আগমনপূর্ব আলামতঃ ইরাক ও সিরিয়ার উপর অবরোধ

আবু নাদ’রা বর্ণনা করেন, আমরা হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি বললেন,

“সেই সময়টি অতি নিকটে, যখন ইরাকিদের ‘দিরহাম’ ও ‘কাফিজ’ এর উপর অবরোধ আরোপ করা হবে”। জিজ্ঞেস করা হল, এই অবরোধ কার পক্ষ থেকে আরোপ করা হবে? উত্তরে তিনি বললেন, “অনারবদের পক্ষ থেকে”। এরপর বললেন, “সেই সময়টিও বেশি দূরে নয়, যখন সিরিয়ার অধিবাসীদের ‘মাদ’ ও ‘দিনার’ এর উপরও অবরোধ আরোপ করা হবে”। জিজ্ঞেস করা হল, এই অবরোধ কার পক্ষ থেকে হবে? বললেন, “পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে”। কিছু সময় নীরব থাকার পর বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার শেষ উম্মতের মধ্যে এমন এক খলীফার (ইমাম মাহদির) আবির্ভাব ঘটবে, যে মানুষকে মুঠি ভরে ভরে সম্পদ দান করবে এবং কোন হিসাব গণনা করবে না”।

(সহিহ মুসলিম, অধ্যায় ৪১, হাদিস নং ৬৯৬১) 

হাদিসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এমনকি অবরোধ আরোপের সিরিয়াল পর্যন্ত দেওয়া আছে। ৬ ই আগস্ট ১৯৯০ থেকে শুরু হওয়া ইরাকি অবরোধ শুরু হয়। আর ২০১১ এর আগস্ট থেকে সিরিয়ার উপরও অবরোধ চলছে।

সিরিয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে শুধু “পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে” বলা হলেও ইরাকের ক্ষেত্রে “অনারবদের পক্ষ থেকে” বলা হয়েছে এবং কুয়েত দখলের পরপরই ৬ ই আগস্ট ১৯৯০ তারিখে হাদিসের শাব্দিক প্রয়োগকে বাস্তবে রুপ দিয়ে প্রথম অনারব সংগঠন (পশ্চিম, পূর্বসহ সকল জাতীয়তার সংগঠন) “আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিষদ” কর্তৃক ইরাকের উপর অর্থনৈতিক ও সব ধরনের বানিজ্যের উপর বানিজ্যিক অবরোধ আরোপ করা হয়। হাদিসে বলা হয়েছে, “ইরাকিদের ‘দিরহাম’ ও ‘কাফিজ’ এর উপর অবরোধ আরোপ করা হবে”।

দিরহাম = অর্থ
কাফিজ = তেল মাপার আঞ্চলিক একক

১ দিনার = ৭২ টি বার্লি দানার সম ওজন সম্পন্ন স্বর্ণ মুদ্রা। বর্তমান ৪.৪৫গ্রাম সোনা।
১ দিরহাম = ০.৭ দিনার (৭০% স্বর্ণ দিনার)

২০০৩ সালে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই ইরাকি সেন্ট্রাল ব্যাংক ইরাকি দিনার নোট থেকে  ‘০০০’ তুলে দিয়ে সমমানের নতুন একক প্রচলনের চেষ্টা করছে। যার প্রথম চালান ২০১৪ তে আসার কথা।

উল্লেখ্য যে, ইতিহাসে ‘কাফিজ’ শব্দটি সব সময়ই তৈল মাপার একক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।  ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিন ইতালির উপর আরব প্রভাব থাকার কারণে তৈল মাপার এককের ক্ষেত্রে সিসিলিয়ান ভাষায় আরবি ভাষার “কাফিজ” শব্দের অনুরূপ  “কাফিসু” (Kafisu /kafiso)   শব্দ এসেছে।

এক টানা ১৩ বছর পর্যন্ত এই অবরোধের পর ২০০৩ সালের ২২ শে মে অধিকাংশ অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। অবরোধের যেই শর্তগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তৈল কোম্পানির অনুকূলে ছিল সেগুলো ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবত ছিল। আর অবরোধের যেই শর্তটি কুয়েত দখলের ক্ষতিপূরণ হিসাবে এখনও ইরাকের গ্যাস ও তৈল বিক্রির উপার্জন উপর থেকে ৫% কেটে নেয়, সেটি এখনও বলবত আছে।

কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং অধ্যাপক রিচার্ড গারফিল্ড তার সেপ্টেম্বর ৪, ২০০৩ এ প্রকাশিত  “The Iraqi babies scam is still alive” নিবন্ধে যুদ্ধ ব্যতীত শুধু এই অবরোধের ফলে অতিরিক্ত ৩,৪৫,০০০ থেকে ৫,৩০,০০০ নারী, শিশু ও বেসামরিক ইরাকির মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন।